ভালোবাসার গল্পঃ এক নির্বাসিতার চিঠি

ভালোবাসার গল্পঃ এক নির্বাসিতার চিঠি 

লিখেছেনঃ হুসাইন শাখী

গাঢ় নীল রঙের মাঝারি সাইজের কার্ড। সাদা, হলুদ, আসমানী রঙের কাগজের ফুলকেটে কেটে বসানো। কিনার ঘেঁষে লাল ফিতে দিয়ে ডিজাইন করা। কার্ডের
ভেতরচার লাইনের কবিতা –

মেঘের তলে মেঘলা চোখে
নদীর টলোমল,
মেঘ থেকে আজ আনবি ছেলে?
চিকন সুঁইয়ের জল?

জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো আসিফ । বুক চিরে চেপে রাখতে চাওয়া দীর্ঘশ্বাসটা বেরিয়ে এলো। কে এত যত্ন করে এসব পাঠায় কে জানে! কার্ডের সাথে পাঠানো চিঠিটা খুললো।

প্রিয় মেঘবালক,
ভালো আছেন, কি করছেন ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্ন করবোনা।

আমি জানিসৃষ্টিকর্তা আপনাকে সুন্দর এবং ভালো রেখেছেন ।

আপনি কি জানেন, এটা আপনার কাছে আমার কততম চিঠি? হয়তো জানেন,
অথবাজানেননা। হতেও পারে চিঠিটা আপনি পাননি। অথবা পেয়েও পড়েননি।

গত আট মাসে আপনাকে পাঠানো প্রত্যেকটা চিঠির জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।জানি
এটা এক ধরণের বাড়াবাড়ি । অসম্ভব রকমের বাড়াবাড়ি ! কিন্তু, এইঅহেতুক
বাড়াবাড়িটায় যেন সূক্ষ্ম সুখ খুঁজে পেয়েছিলাম আমি।

আমি কে, আপনাকে কিভাবে চিনি, আপনি আমাকে চেনেন কিনা এসব প্রশ্ন
হয়তোআপনাকে জরাজীর্ণ করে ফেলছে। বলবো। আজ সবটা বলবো।

আমি অনেক দিন আগে আপনার আশেপাশের কোন বাড়িতে থাকতাম। কী অসম্ভব
বিষন্নতানিয়ে মাঝে মাঝে বারান্দায় বসে থাকতেন আপনি। আমি দূর থেকে
দেখেছিলাম। কখনোবই পড়ে হাসতেন, কী স্বচ্ছ সেই হাসি! হঠাৎ ওঠা ঝড় থেমে
যাওয়ার পর নদীর জলযেরকম শান্ত হয়ে যায়, সেরকম।

আপনি কি জানেন, আপনাকে যখন চিঠি লিখি তখন আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে
পানিপড়ে? আমি ছোটবেলা থেকেই কেমন আলাদা হয়ে থাকতাম। আসলে থাকতাম না।
রাখাহতো। তারপর যখন একটু বড় হলাম তখন নিজে থেকেই একা একা থাকতাম। ততদিনে
বুঝে গিয়েছিলাম, আমাকে একাই চলতে হবে।

সবাই নাক ছিটকানী দিলেও আমার ভাইয়া আমাকে খুব আদর করতো। দুপুরবেলা সবাই
ঘুমিয়ে গেলে আমরা একসাথে বাড়িরপেছনের মাঠে বসে খেলতাম, ঘাস ফড়িং ধরতাম।
লুকিয়ে লুকিয়ে ভাইয়া আমার জন্যকিটক্যাট কিনে আনতো। ভাইয়া আমার সাথে বেশি
মিশলে সবাই বকতো। তাই একটা সময় আমিনিজেই ভাইয়ার থেকে দূরে দূরে থাকতাম।
দুপুরবেলা ঘুমিয়ে থাকার ভান করতাম, ভাইয়া ডাকলে না শোনার ভান করে ঠায়
বসে থাকতাম। কিন্তু ভাইয়া ঠিকই লুকিয়ে আমাকে খেলনা, রং পেন্সিল কিনে
দিতো! আমি তবুও দরজা বন্ধ করে বসে থাকতাম! ভাইয়াকে কেউ বকলো আমার খুব
খারাপ লাগতো।

ভাইয়া বোধহয় আমার উপর খুব অভিমান করেছিলো। হুট করে আমাকে রেখে আকাশের
তারা হয়ে গেল। আর আমিও একা হয়ে গেলাম। দুপুরবেলা সবাই যখন ঘুমে তখন
ভাইয়া পুকুরের পানিতে পড়েগিয়েছিল । ওরা বলতো সেটাও নাকি আমার দোষ! তার পর
থেকে আমি আরো বাজে সময় পাড় করতে থাকলাম।

অনেক বছর পর, আমি তখন উনিশ । ততদিনে আমার সবার অবহেলার সেই “বাজে
সময়”গুলো গা সওয়া হয়ে গেছে..একদিন বড় ফুপু আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে
গেলেন।কারো গলায় আমাকে ঝুলিয়ে দেবার জন্য । একটার পর একটা সম্বন্ধ আসছিল
। কিন্তু সবগুলো সম্বন্ধই ভেঙে যাচ্ছিলো! কে এই খরকুটো কে আশ্রয় দেবে
বলুন?

সেই ফুপুর বাড়ির বারান্দা থেকে আপনাকে দেখেছিলাম ।তারপর ষোল বছর বয়সী
বালিকার মতন ধীরে ধীরে মুগ্ধ হতে লাগলাম। নিজের অপারগতার কথা বেমালুম
ভুলে গেলাম…

ফুপু হতাশ হয়ে আমাকে বাবা মার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। আমি তখনো আপনাতেই মগ্ন!
তারপর আপনাকে চিঠি লেখার ভূত মাথায় জেকে বসলো। আর সেই ভূতের ইশারায়
আপনাকে একটার পর একটা কার্ডআর চিঠি পাঠাতে লাগলাম।এর একটা শেষ টানা
দরকার । আমি সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম সৃষ্টিকর্তা আমাকে কথা বলার ক্ষমতা
দেননি। হ্যাঁ, আমি কথা বলতে পারিনা। আপনারা বোধহয়আমাদের বোবা বলেন।
বোবাদের কি মেঘবালকের প্রেমে পড়তে আছে? স্বপ্ন দেখতে আছে? না, সেই অধিকার
তাদের দেয়া হয়নি।

এটাই আপনাকে দেয়া আমার শেষ চিঠি । খুব ভালো থাকবেন।

ইতি
একজন নির্বাসিতা

চিঠি হাতে বারান্দায় বসে আছে আসিফ ।মনের অজান্তেই চারপাশের সবকটাবারান্দায় চোখ বুলিয়ে নিলো, না, কেউ নেই। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে
হুইলচেয়ারটার দিকে তাকালো। দু’মাস আগের ঘটে যাওয়া ভয়াবহ রোড এ্যাকসিডেন্টের কথা মনে পড়ে গেল।মনে মনে বললো, নির্বাসিতা, তুমি যদি
জানতে আমাকে ওরা হুইল চেয়ার কিনে দিয়েছে, তখনোকি এটা তোমার শেষ চিঠি হতো?

আবারো বাইরে তাকালো আসিফ। বিকেলের মরে আসা রোদে কি বিচ্ছিরি লাগছে চারপাশের সবকিছু!!

Related posts

Leave a Comment